তাঁত শিল্প ও জি আই পণ্য
গত ২০ মে ২০২৩ তারিখে ’তাঁত শিল্প ও জি আই পণ্য’ শীর্ষক ইভেন্ট করেছে মিরপুরের কয়েকজন দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন রিংকি’স এট্যায়ারের স্বত্বাধিকারী রেহমুমা হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি)-এর স্বত্বাধিকারী নিগার ফাতেমা, ট্রেজারার উম্মে সাহেরা এনিকা, আলিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী জেনিস ফারজানা তানিয়া, দোলা রোদেলা বুটিক’সের স্বত্বাধিকারী আইরিন আক্তার রিতা এবং লাবণ্য বাই ইশরাতের স্বত্বাধিকারী ইশরাত চৌধুরী। এই ইভেন্টে তাঁত শিল্প ও জি আই পণ্য নিয়ে জেনিস ফারজানা তানিয়ার বক্তব্যের শ্রুতি লিখন:
… বাংলাদেশের প্রচীন শিল্পের মধ্যে তাঁতশিল্প অন্যতম। তাঁতশিল্পের গভীরতা বুঝতে হলে ইতিহাসে ডুব দেওয়ার বিকল্প নেই। তাঁতশিল্প আমাদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং ও র্যালফ ফিচের ভ্রমণকাহিনিতে তাঁতশিল্প, কাপড় বুনন এবং তুলা থেকে সুতা তৈরির করা উল্লেখ পাওয়া যায়। মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে এই অঞ্চরের তাঁতশিল্প।
একটা সময় কৃষি এবং তাঁতই ছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ফিলার। দেশবাসী সেই প্রাচীনকাল থেকে নিজেরা তাঁতপণ্য ব্যবহারের পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করে আসছে। তার নিদর্শন ঢাকাই মসলিন ও জামদানি। ইতিহাস থেকে জানা যায় বিশ্বের বিভিন্ন রাজ দরবারে বাংলার তাঁত বস্ত্র ব্যবহার হতো। তখনকার সময় আমাদের তাঁত পণ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের। আরব বণিক থেকে শুরু করে ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল তাঁতশিল্প।
পুঁজিবাদ আর আধুনিক যান্ত্রপাতির কারণে তাঁতশিল্পের জৌলুসে ভাটা পড়লেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি। দেশের তাঁতশিল্প এখনো মানুষের চাহিদা পূরণ করে জাতীয় অর্থনীতিতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখছে। হস্তচালিত শিল্পকে ধরা হয় দেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। ২০০৩ সালের তাঁতশুমারী অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ৫ লক্ষাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। যা দেশের মোট কাপড় চাহিদার প্রায় ৭৫ ভাগ পূরণ করে। শিল্পের সাথে তাঁতি, মহাজন, ব্যবসায়ী মিলে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।
দেশ বিদেশে তাঁত পোশাকের ব্র্যান্ডিং বাড়াতে এবং পূরানো ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর সামনে তোলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে জিআই নিবন্ধন। আমাদের তাঁতশিল্পে শতাধিক রকমের শাড়ি উৎপাদন হয়, ৮০ রকমের বেশি লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, থ্রিপিস, গামছা, বেডশীডসহ দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের অর্ধশত পণ্য বহুকাল ধরে নিয়মিত উৎপাদন হয়ে আসছে। এসব পণ্য নিয়ে চেষ্টা করলে অন্তত শতাধিক জিআই নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যা এই শিল্পের ব্র্যান্ডিং দেশ বিদেশে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুফল বাড়াবে। এতে করে দেশের তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান এবং বাড়বে ডলারের রিজার্ভ।
তাঁত পণ্যের জিআই নিবন্ধন বাড়াতে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ দেশের মানুষ এখনো জিআইয়ের সুফল সম্পর্কে অবগত নয়। তাই আমাদেরকে নিয়মিত লিখতে হবে ফেসবুকে এবং গণমাধ্যমে। ডেইলি সানে প্রকাশিত কাকলী আপুর আর্টিকেলগুলো সবাই নিজ নিজ প্রোফাইলে শেয়ার করতে হবে। জিআই নিয়ে স্যারের গাইডলাইনগুলো, জিআই নিয়ে বিভিন্ন মিটিং সেমিনার, আবেদন, ডকুমেন্টেশন ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত লিখতে হবে। তাহলে একটু একটু করে মানুষের মাঝে বাড়বে জিআই সচেতনতা। এর সুফল বুঝতে পারলে ধাপেধাপে সবাই এগিয়ে আসবে। তবে এরজন্য আমাদের বসে থাকলে চলবে না। বরং নিয়মিত কাজ করে যেতে হবে, জানতে হবে এবং প্রাচরে অংশ নিতে হবে।
তাঁতের কোন কোন পণ্যগুলো জিআই নিবন্ধন পেতে পারে, এগুলোর নিবন্ধন পেলে তাঁতি থেকে শুরু করে মহাজন ও ব্যবহারকারীরা কীভাবে উপকৃত হতে পারে এসব নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করতে হবে। এরজন্য আমি কাকলী আপুর কথাই বলবো। আপু গত ২ মাস ধরে নিয়মিত নরসিংদীর পণ্যগুলো নিয়ে নিজের প্রোফাইলে লিখে চলছেন। এতে করে সম্ভাবনার পাশাপাশি উঠে আসছে পর্দার আড়ালের গল্পগুলো।
ডকুমেন্টেশন বাড়ানোর জন্য সাহিত্যের পাশাপাশি গুগলে সার্চ করে পড়ার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি, লেখক তাদের লেখায় গুরুত্বের সাথে স্থান নিয়েছে বাংলার তাঁত শিল্পকে। এই মুহূর্তে ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ’চরকার গান’ কবিতার কয়েক লাইন মনে পড়ে গেল-
চরকায় সম্পদ, চরকায় অন্ন,
বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ!
বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন-তৌলেই কিনতেন একদিন।আমি সাহিত্যের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এই কারণে বলছি যে, নিউজ, ফিচার বা সম্পদকীয়গুলোতে বিভিন্ন রেফারেন্স পাওয়া যায়। তা আমরা খুব সহজে খুঁজে নিতে পারব। এতে করে ডকুমেন্টেশন তৈরিতে সময় বেঁচবে এবং অধিক সংখ্যক রেফারেন্স যুক্ত করার সুযোগ হবে। উপস্থিত সবাইকে জিআই নিয়ে এগিয়ে আসার এবং কাজ করার অনুরোধ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।