ঢাবি : জিআই পণ্য বৃদ্ধিতে করণীয়
গত ২০ জুন ২০২৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন অনুষদে বাংলাদেশে জিআই পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আলিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী জেনিস ফারজানা তানিয়া। সভাপতির বক্তব্যের শ্রুতি লিখন:
জিআই পণ্য নিয়ে এত চমৎকার একটি সেমিনার আয়োজন করার জন্য ঢাবির আইন অনুষদ, ডিপিডিটি ও ইডিসিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সেই সাথে ধন্যবাদ জানাতে চাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের জিআই পণ্য বৃদ্ধিতে কাজ করা আরিফা মডেলের উদ্যোক্তাদের। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ই-ক্যাবের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যারের আন্তরিকতার কারণে আরিফা মডেল অনুসরণকারী অন্তত ১০০ উদ্যোক্তা জিআই পণ্য বৃদ্ধিতে কাজ করছে। ময়মনসিংহের খাতুনে জান্নাত আশা আপু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্থাৎ জিআই ডকুমেন্টেশন তৈরিতে সহযোগিতা করছেন। এ জন্য আমি স্যার এবং আশা আপুকে ধন্যবাদ জানাই।
আমরা জানি জিআই আবেদন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে যথাযথ ডকুমেন্টশন তৈরি করা। এর জন্য একদম মাঠ পর্যায়ে তাঁতি, কারিগরদের কাছে গিয়ে সঠিক তথ্য, ছবি অনুসন্ধান করতে হয়। প্রাচীন দলীল বের করতে হয়। তাই পুরাতন বইপত্র প্রয়োজন হয়। আমাদের জেলা পর্যায়ের প্রাচীন বইগুলো দুর্লভ। পাবলিক লাইব্রেরি, বুক স্টোর কিংবা অনলাইনেও অনেক সময় পাওয়া যায় না। কিন্তু তারপরও আরিফা মডেলের উদ্যোক্তারা কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জিআই পণ্য বৃদ্ধিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপিডিটি ও ইডিসির আন্তরিকতা রয়েছে। সাথে আছে আরিফা মডেলের ১০০ উদ্যোক্তা। আমরা লক্ষ্য করেছি সবাই মিলে কাজ করল ডকুমেন্টেশন তৈরি করা কঠিন কিছু না।
আমরা যখন চটপটির জিআই ডকুমেন্টেশন নিয়ে চেষ্টা শুরু করি তখন কিছুই ছিল না হাতের নাগালে। আরিফা মডেলের উদ্যোক্তারা মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নিউ মার্কেট ও ধানমন্ডিতে ঘুরে ঘুরে হকার্সদের সাথে কথা বলেছে, তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং ফটোগ্রাফি করেছে। পরে আমরা ঐতিহাসিক দলীলের অভাবে পড়লাম। তখন সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে অনুসন্ধান করতে করতে ইডেন কলেজের মেয়েদের চটপটি খাওয়ার একটি ছবি পেলাম, যেটি ১৯৭৮ সালের। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত এ জে মিন্টু পরিচালিত লালু মাস্তান মুভি গান পেলাম। তা ৩৮ বছর আগের। আমাদের আরেক উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধুর চটপটি খাওয়ার গোয়েন্দা রিপোর্টের সোর্স ইন্টারনেটে পেলেন। এভাবেই আমরা চটপটির ঐতিহাসীক দলীল পেয়ে গেছি। তা সম্ভব হয়েছে সম্মেলিত চেষ্টার ফলে।
আমাদের দেশে জিআই নিয়ে গবেষণা নেই। এদিকে গবেষণা দরকার। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রচার কেমন বেড়েছে, চাহিদা কেমন তৈরি হয়েছে, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে ভূমিকা কতটুকু বেড়েছে এই বিষয়গুলো গবেষণা করে সকলের সামনে তোলে ধরা দরকার। তাহলে মানুষ জিআইয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে এবং এদিকে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হবে।
জিআই নিয়ে আমাদের পলিসি লেভেলে কোন কাজ নেই। যে আইপি পলিসি রয়েছে সেখানে জিআই নিয়ে তেমন কিছু নেই। এদিকে কাজ করা দরকার। যেহেতু জিআই আমাদের দেশে এখনো নতুন একটা কনসেপ্ট বলা যায়। তাই এদিকে সবকিছুতেই ফাঁকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপিডিটি, ইডিসিসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কাজ করতে হবে।
জিআই নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ মার্কের কোর্স নেই। শর্ট কোর্সও নেই। অথচ এটা জাতীয় অর্থনীতির জন্য দরকার। আমরা এখন ডলারের ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যার কারণে জাতীয় বিদ্যুৎ সেবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিকে আমরা সাফার করছি। যদি জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে থাকতো এবং ডলার সংকট না থাকতো তাহলে শিশু থেকে বৃদ্ধ কাউকে ততটা সাফার করতে হতো না। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে দেশের স্বার্থে এবং নিজের স্বার্থে।
কোভিডের আগেও ভারতীয় পোশাকের দাপট ছিল বাংলাদেশে। ইদের বাজারে তাদের শক্ত অবস্থান ছিল। এসব পণ্য আমদানি করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর ডলার ব্যয় হয়। রাজিব আহমেদ স্যার যখন সক্রিয়ভাবে দেশি পণ্যের প্রচার বাড়াতে ফেসবুককে কাজে লাগাতে শুরু করলেন এবং উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলেন, তখন থেকে তাঁতের পোশাক, হোম মেড খাবারসহ দেশি পণ্যের প্রচার, কাস্টমার, চাহিদা, উদ্যোক্তা সবই বেড়েছে। এখন রাস্তা দিয়ে চলার পথে দেশি পোশাকই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। তাই বলা যায় পোশাকে আমদানি চাহিদা কিছুটা হলেও কমেছে এবং দেশি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের তাঁতি, কারিগরদের কদর ও রোজগার বেড়েছে।
জিআই আবেদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য ডিপিডিটি থেকে আমাদের আরও বেশি সক্রিয় সাহায্য দরকার। আরিফা মডেলের ভলান্টিয়াররা ডকুমেন্টেশন বাড়াতে কাজ করছে কিন্তু তারা আবেদন করতে পারে না। তাই যেতে হয় পণ্য সংশ্লিষ্ট সমিতি, দপ্তর কিংবা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তারা জিআইয়ের গুরুত্ব বুঝতে না পেরে সেভাবে আগ্রহ প্রকাশ করে না। অনেক সময়ই গরিমসি করে আবেদন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এদিকে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আমি আর কথা বাড়াবো না। আগে আমাদের ১১টি জিআই পণ্য ছিল। এখন শেরপুরের তুলশীমালা চাল, বগুড়ার দুই এবং বাংলাদেশের শীতল পাটি জিআই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। আমরা আশাকরি প্রতি মাসেই আমাদের জিআই পণ্য বাড়বে। সর্বশেষ বলতে চাই, ‘বাড়ুক আমাদের জিআই পণ্য এবং শক্তিশালী হোক আমাদের অর্থনীতি।’