নরসিংদীর সম্ভাব্য জিআই পণ্য
রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যে নরসিংদী অন্যতম। ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি ও ভৌগোলিকভাবে নরসিংদীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ জেলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হলেও প্রাচীনকাল থেকে তাঁত শিল্পের বিশেষ অবদান রয়েছে। মাটি, পানি ও আবহাওয়ার গুণগত কারণে নরসিংদীতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কিছু পণ্য রয়েছে। যা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেতে পারে। নরসিংদীর সম্ভাব্য জিআই পণ্যগুলো নিচে তোলে ধরা হলো:
নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা
নরসিংদীর সাগর কলার দেশের অন্য যেকোন জায়গার সাগর কলার চেয়ে স্বাদ ও আকৃতিতে ভিন্ন। একই কলার অন্য কোথায় চাষ করলে থাকে না সেই স্বাদ। নরসিংদীর মাটি ও আবহাওয়ার কারণে অমৃত্ত সাগর কলা স্বতন্ত্র হয়েছে। কয়েকশ বছর ধরে নরসিংদীতে উৎপাদন হয়ে আসছে অমৃত্ত সাগর কলা। তা চালান হয় রাজধানীসহ দেশের অন্য জেলায়। জানা যায়, ”পাকিস্তান আমলে কলার রপ্তানির জন্য একটি লোকাল ট্রেনের নামকরণ হয়েছি কলার গাড়ি নামে।” এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেটে লাইনের সকল ট্রেনে কলার জন্য আলাদা বগি থাকত।
আরাও জানা যায়, ”নরসিংদীর কলার স্বাদ, গন্ধ, রঙ ও আকার সুন্দর হওয়ার কারণে তা ঢাকার নবাবদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য পেত।” নরসিংদীর কলার সাথে জড়িয়ে আছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। বংশপরম্পরায় বহু বাগানি চাষ করে দেশি অমৃত সাগর কলা। যা তাদের জীবিকা নির্বাহে অবদান রাখছে। অনেক চাষির প্রধান জীবিকা মাধ্যমই কলা চাষ। সম্প্রতি ইডিসি টিমের সহযোগিতায় নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অমৃত সাগর কলার স্বীকৃতি চেয়ে ডিপিডিটি বরাবর আবেদন করা হয়েছে।
নরসিংদীর লটকন
লটকন বেশ পরিচিত একটি ফল। নরসিংদীসহ সারাদেশে উৎপাদন হয়। তবে মাটি ও আবহাওয়ার কারণে নরসিংদীর ফলন, স্বাদ ও আকৃতি ভিন্ন। নরসিংদীতে ব্যাপক লটকন আবাদ হওয়ার কারণে ’লটকেনর রাজ্য’ বলে থাকেন অনেকে। নরসিংদীতে প্রতিবছর বাড়ছে লটকনের চাষ। জ্যেষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত বাগানে লটকনের ফলন থাকার কারণে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে পর্যটকের আগমন ঘটে। লাভজনক চাষাবাদ হওয়ার কারণে স্থানীয় লোকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দেয় লটকন। জেলার বিপুল পরিমাণ মানুষ লটকন চাষে জড়িত।
নরসিংদীর লটকন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। এর ফলে শক্তিশালী করছে নরসিংদীর অর্থনীতি। এই লটকন জিআই স্বীকৃতি পেলে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বাড়বে এর পরিচিতি ও কদর। যা স্থানীয় উৎপাদনের সুযোগ বাড়াবে। এতে করে হবে কর্মসংস্থান ও আসবে রেমিট্যান্স। অমৃত সাগর কলার সাথে লটকনেরও জিআই স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নরসিংদী।
নরসিংদীর তাঁতবস্ত্র
বহুকাল ধরে নরসিংদীর অর্থনীতিতে দারুণভাবে অবদান রেখে চলেছে তাঁতশিল্প। এ শিল্পের সাথে প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থান জড়িত। তাঁতীরা তাদের সৃজনশীতা কাজে লাগিয়ে বুনে থাকে বহুমুখী তাঁতবস্ত্র। এছাড়াও কেউ কেউ কারুকাজের মাধ্যমে প্রকাশ করেন তাদের সুনিপুন দক্ষতা। আর এতে চলে তাদের রুটির ঝুড়ি। আধুনিক কলকারখানার সাথে প্রতিযোগিতা করে জেলায় এখনো ৮০-৯০ হাজারের মতো তাঁত রয়েছে।
নরসিংদীর তাঁত বস্ত্র দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও বিস্তার লাভ করেছে। এর ফলে সমৃদ্ধি হচ্ছে নরসিংদীর অর্থনীতি। বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা যায়, নারসিংদীর তাঁতশিল্প দেশের তাঁতের পোশাকের ৭০ ভাগ যোগান দেয়। নরসিংদীর তাঁতশিল্প বেশ পুরানো শিল্প। বাবুরহাট তার নিদর্শন। ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁতপণ্যের জন্য প্রসিদ্ধ এই হাট। নরসিংদীর সম্ভাব্য জিআই পণ্য হিসেবে অনেক গুলো তাঁত পণ্যের তালিকা করার সুযোগ আছে।
বাদশাভোগ মিষ্টি
নরসিংদীর একটি বিখ্যাত মিষ্টির নাম বাদশাভোগ। দেখতে অনেকটা রসগোল্লার মতো হলেও আকার ও স্বাদ ভিন্ন। প্রায় শতাধিক বছর ধরে নরসিংদীর বিভিন্ন মিষ্টি দোকানে বংশপরম্পরায় তৈরি হয় বাদশাভোগ। বাঙালিরা মিষ্টি প্রিয় হওয়ার কারণে জিআই পণ্যের তালিকাভুক্তির মাধ্যমে দেশবিদেশে বাদশাভোগের ব্র্যান্ডিং বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা হওয়ার কারণে দেশি পণ্যের ই-কমার্সের মাধ্যমে নিয়মিত সরবরাহের সুযোগ রয়েছে এই মিষ্টি। এর ফলে দিনে দিনে বাড়বে পরিচিতি ও চাহিদা। যা কর্মসংস্থান তৈরিতে অবদান রাখবে। এটিকে আমরা নরসিংদীর সম্ভাব্য জিআই পণ্য হিসেবে দেখছি।
কলম্বো লেবু
অন্যান্য লেবুর চেয়ে কলম্ব সুগন্ধিযুক্ত, লেবু বড় ও রসালো। মাটির বিশেষ গুণের কারণে এই লেবু নরসিংদীতে ভালো উৎপাদন হয়। বর্তমানে নরসিংদী জেলার চারটি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে এই লেবুর চাষ।
কলম্বো লেবু দেশে বিক্রি হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব বাজারে রপ্তানি হয়। এই লেবু চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন শতশত কৃষক। তাই শিক্ষিত তরুণরাও ঝুকছে কলম্বো লেবু চাষে। লেবুর বাকলে মিষ্টি ঘ্রাণ রয়েছে। এই লেবুর বাকল মোটা। তাই কলম্বো লেবুর বাকল খাওয়া হয়। খোসা দিয়ে তৈরি করা হয় আচারও।