দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রিটিশ আমল থেকে এই ভূখণ্ড দেশে-বিদেশে পরিচিত ছিল সংস্কৃতি অঙ্গনে। তিতাস বিধৌত এই জেলাকে বলা হয় শিল্প ও সংস্কৃতির রাজধানী। প্রাচীন ও আধুনিক শিল্প কারখানা নিয়ে এগিয়ে চলছে এ জেলা। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি সম্ভাবনায় জেলা। এখানে উৎপাদিত পণ্যগুলো আধুনিক প্রযুক্তি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধাকে লুফে নিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারে জেলার পরিচিতি ও অর্থনীতি। দেশের বিশেষ পণ্যগুলোকে স্বতন্ত্র পরিচয় দিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে চালু হয়েছে জিআই নিবন্ধন ও স্বীকৃতি প্রক্রিয়া। এর ফলে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে দেশের ২১টি বিশেষ পণ্য। যা আমাদের গর্ব। এই ২১টির একটাও নেই এই জেলায়। কিন্তু জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার মতো আমাদেরও বেশ কিছু পণ্য রয়েছে। আজকে আলোচনা করবো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্ভাব্য জিআই পণ্য নিয়ে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী
শতবর্ষ আগে মহাদেব পাঁড়ে নামক এক ব্যক্তির হাত ধরে শহরের মেড্ডায় ছানামুখীর উৎপাদন শুরু হয়েছিল শিবরাম মোদকের মিষ্টির দোকানে। [১] এটি শক্ত, চারকানো, ক্ষুদ্রাকার এবং উপরে জমাটবাঁধা চিনি প্রলেপ যুক্ত। দেখতে শুকনা, কামড় বসালে হালকা রস আসে মুখে। যা তৃপ্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে শহরের মিষ্টি দোকানে পাওয়া যায় ছানামুখী। বংশ পরম্পরায় মিষ্টি ব্যবসা ধরে রেখেছে এসব ব্যবসায়ীরা।
গত একশ বছরের ইতিহাসে সারাদেশের পরিচিতি ও চাহিদা বেড়েছে ছানামুখীর। জেলার আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক রাখাল চন্দ্র মোদকের দাবি, “বাংলাদেশের আর কোথাও ছানামুখী তৈরি হয় না।” পানি ও আবহাওয়ার কারণে স্বাদে অনন্য ব্রাহ্মণবাড়ির ছানামুখী। তাই অন্য কোথাও উৎপাদনের করা হলেও স্বাদ পাওয়া যায় না ব্রাহ্মণবাড়য়িার মতো। এ কারণে আশেপাশের জেলাগুলো থেকে ছানামুখী কনিতে জেলা শহরে আসে অনেকে। প্রবাসীরা বিদেশে যাওয়ার সময় সাথে করে নিয়ে যায় এই ছানামুখী। এই মিষ্টিকে ঐতিহ্য হিসেবে পরিচয় দেয় স্থানীয়রা। আতিথি আপ্যায়নেও গুরুত্ব পায় ছানামুখী।
লেডি ক্যানি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তৈরি হওয়া এক প্রকার মিষ্টির নাম লেডি ক্যানি। এই মিষ্টির স্রষ্টা বলা হয় মহাদেব পাঁড়ে-কে। নামরকরণ নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে। এই মিষ্টির ইতিহাস রয়েছে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাথে। এই মিষ্টি খেয়ে তিনি বেশ প্রশসংসা করেছেন। এই সংবাদ পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে প্রচারও হয়েছে। [১] এই একদম কালোজামের মতো নয়। এটি তৈরি করা হয় ছানা দিয়ে। রসটা হয় পাতলা। এ মিষ্টির ভেতরটা ফাঁপা ও রসে টইটম্বুর। [২]
তাঁত শিল্প
বাপ-দাদা থেকে পাওয়া পেশায় এখনো চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাঁতিদের জীবিকা। শিল্প বিপ্লবের সাথে ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল জেলার নবীনগর-বাঞ্চারামপুরের তাঁত শিল্পের। এখানে তৈরি হতো শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ নানা রকম তাঁত পণ্যের। যা দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে।
তাঁত শিল্পের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৬ সালে বাঞ্চারামপুর উপজেলায় তিতাস নদীর পূর্বপাড়ে তাঁতপণ্যের উৎপাদনের জন্য ‘সার্ভিসেস অ্যান্ড ফ্যাসিলিটি সেন্টার (তাঁতকেন্দ্র)’ নির্মাণ করেছে তাঁত বোর্ড। জেলায় কয়েক হাজার হস্ত চালিত তাঁত কারখানায় তৈরি হতো নানা রকম দেশি পোশাক। জিআই স্বীকৃতি পেলে বাড়বে এসব তাঁত বস্ত্রের প্রচার, প্রসার ও চাহিদা। তাই পেশাটি রাক্ষা পেতে পারে বিলুপ্তির হাত থেকে এবং নতুন প্রজন্মের আগ্রহ তৈরি হতে পারে এই পেশায় যুক্ত হওয়ার। শিক্ষিত প্রজন্ম তাঁত শিল্পের হাল ধরলে মানুষের চাহিদা বোঝে নতুনত্ব যোগ করবে। যা এই শিল্পে খোলবে নতুন দুয়ার।
পাদুকা শিল্প
গত কয়েক দশক ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রসার লাভ করেছে পাদুকা শিল্প। তা দেশে বিক্রি হওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি হয় বিদেশে। প্রতিবছর বাংলাদেশে কয়েক কোটি চামড়া পাওয়া যায়। তার কিঞ্চিত ব্যবহার হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যানুয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোতে। স্থানীয় কাঁচামালের ব্যবহার ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য এই শিল্পের সমিতিসহ বিভিন্ন মহলকে এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। তাহলে হয়তো আমরা তৈরি পোশাক খাতের মতো করে স্বপ্ন দেখতে পারব পাদুকা শিল্প নিয়ে।
পাদুকা শিল্প মালিক সমিতি, জেলা প্রশাসন কিংবা অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠান পাদুকা শিল্পকে জিআই নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করতে পারে। এটি সারাবিশ্বে আমাদের ব্র্যান্ডিং-কে সমৃদ্ধ করবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে ১০ হাজারের বেশি মানুষের জীবিকা নির্বাহ। যা তাদের আয়ের প্রধান উৎস। জানা যায়, ভারতের পাটনার মাহমুদ আলী নামের ব্যবসায়ী ১৯৬৩ সালে ১০-১২ জন শ্রমিক নিয়ে প্রথম জুতা কারখানা দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। [১] এর পর থেকে আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করে হাতে তৈরি জুতার কারখানা।