সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জনপদের নাম সিলেট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হওয়ার কারণে সিলেটের ব্র্যান্ডং স্লোগান করা হয়েছে ‘প্রকৃতি কন্যা সিলেট’ নাম। এ জেলা বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর। পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ সিলেট। এই জনপদ সম্পদের ভরপুর হলেও সিলেট জেলার একটিও জিআই পণ্য নেই। অথচ জিআই পণ্যের দিক থেকে প্রথম সারি একটা জেলা হতে পারে সিলেট জেলা।

এখানের রয়েছে জলবায়ু ও ফসলে বৈচিত্র। এর মধ্যে চা, সাতকরা, কমলা, পান সহ অসংখ্য পণ্য রয়েছে জিআই স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। সিলেট অঞ্চলে সুপ্রসিদ্ধ শীতলপাটি উৎপাদন হলেও বিসিকের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শীতলপাটি হিসেবে জিআই মর্যাদা পেয়েছে। সে হিসেবে সিলেট জেলা জিআই পণ্যের সংখ্যার দিক থেকে শূন্যের কোটায় অবস্থান করছে। আজকে আমি আলোচনা করবো সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য নিয়ে। যেগুলো জিআই অর্জন করার মতো সব ধরনের শর্ত পূরণ করতে সক্ষম বলে আমার বিশ্বাস।

সিলেটের চা
সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য চা। ছবি: ইন্টারনেট

সিলেটের চা

সিলেটে উঁচু-নিচু টিলায় ভরপুর হওয়ার কারণে এখানকার মাটি ও জলবায়ু চা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। এর জন্য ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’ নামে খ্যাতি অর্জন করেছে সিলেট। উপমহাদেশে চা’য়ের চাষ শুরু হয় সিলেটে। এখানকার প্রথম চা বাগানের নাম মালনীছড়া। যা তখনকার ইংরেজ কালেক্টর ও ব্যবসায়ী হার্ডসনের হাতে ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। এই ব্যবসায়ীর মাধ্যমে চা সহ আরও অন্যান্য ফসলের চাষ হয়েছিল সিলেটের মাটিতে। মালনীছড়া চা বাগান একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানও। দেশ বিদেশে থেকে পর্যটকরা ভীড় করেন মালনীছড়ায়। এই চা বাগান একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহক।

সিলেটে মালনীছড়ার পাশাপাশি আরও ২০টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাক্কাতুরা চা বাগান, তারাপুর চা বাগান, কালাগওল চা বাগান, চিকনাগুল চা বাগান ছাড়াও শতশত চা বাগান রয়েছে। সরকারি হিসাব বলছে ২৮ হাজারের বেশি চা চাষ হয় সিলেট জেলায়। দেশের বিক্রি করার পাশাপাশি পাঠানো হয় বিদেশে। সিলেটের চা জিআই স্বীকৃতি পেলে দেশ বিদেশে আরও বেশি চাহিদা ও ব্র্যান্ডিং হবে। যা কর্মংস্থান ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

সিলেটের বেত পণ্য
সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য বেত পণ্য। ছবি: ইন্টারনেট

সিলেটের বেত পণ্য

বেত পণ্য সিলেটের ঐতিহ্য। সিলেটের প্রায় সব বাড়ি ঘরে বেত পণ্যের ব্যবহার হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। অতিথিদের খুশি করতেও বেত পণ্যের উপহার দিয়ে থাকেন সিলেটবাসী। সব মিলিয়ে এটি যেমন সিলেটের ঐতিহ্য একই সাথে সিলেটের সংস্কৃতির অংশ। এই বিখ্যাত পণ্যের জন্য সিলেটের ঘাসিটুলায় বেতপল্লী গড়ে উঠেছে বহু আগে। এখানকার উৎপাদিত বেত পণ্য কেবল সিলেটে নয় দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণে অবদান রাখছে। বেত পণ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি ৫ হাজার মানুষের শ্রম ও দক্ষতা জড়িয়ে আছে। এছাড়াও বিক্রি ও অন্যান্য ভাবে আরও হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে সিলেটের বেত শিল্পে। একটা মিথ আছে কারিগরি দক্ষতার যেন হেরপের না হয় তাই ঘাসিটুলার ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো না অন্য কোথাও।

সিলেট পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানকার বনাঞ্চলে বেতের উৎপাদন খুবই ভালো হয়। তাই বলা যায় এখানাকার মাটি ও আবহাওয়া বেত পণ্যের জন্য বিশেষ উপযোগী। আর জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য স্থানীয় মাটি, জলবায়ুর বিশেষ ভূমিকা থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও জিআই স্বীকৃতির অন্যতম শর্ত হলো যেকোন পণ্যের ইতিহাস ৫ দশকের বেশি হওয়া শ্রেয়। জানা যায়, “১৮৮৫ সালের দিকে প্রথম বেত পণ্য উৎপাদন হয় সিলেটে।” দেশের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি প্রবাসীদের মাধ্যমে যায় বিদেশেও। এই বেত থেকে কেবল ১-২ রকম নয় অন্তত ৫০ রকমের পণ্য উৎপাদন হয়ে আসছে। তাই অন্তত ১০ রকম বেত পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পেতে পারে।

সিলেটের সাতকরা
সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য সাতকরা। ছবি: ডেইলি স্টার

সিলেটের সাতকরা

টক ও সুগন্ধি স্বাদের এক প্রকার ফলের নাম সাতকরা। তবে সাতকরা লেবু কিংবা কমলা নয়। এটি স্বতন্ত্র একটি পণ্য। লেবু যেমন কাঁচা খাওয়া যায়, তেমনি সাতকরা খেতে হয় মাংস কিংবা মাছ দিয়ে তরকারি রান্না করে অথবা আচার বানিয়ে। সর্বপরি প্রক্রিয়াজাত করে। সাতকরা সিলেটের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী ফলের নাম। পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় ফল। সাতকরা একটি অর্থকরী ফসল। অগণিত মানুষের উপার্জন মাধ্যম হচ্ছে এই সাতকরা। জিআই স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করার সুযোগ আছে সাতকরা নিয়ে।

খাসিয়া পান
সিলেটের সম্ভাব্য জিআই পণ্য খাসিয়া পান। ছবি: প্রথম আলো

খাসিয়া পান

সিলেট পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কারণে সিলেটের মাটিতে বেশ কিছু আদীবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম খাসিয়া। অনেকগুলো পুঞ্জ বা গ্রামে ছড়িয়ে আছে খাসিয়াদের বসবাস। তাদের প্রধান উপার্জন মাধ্যম কৃষি। তাদের জুম চাষে পানের চাষ বহুকাল ধরে হয়ে আসছে সিলেট অঞ্চলে। অন্য পানের চেয়ে আকার আকৃতি ও স্বাদের পার্থক্য রয়েছে খাসিয়া পানে। একই সাথে রয়েছে উৎপাদন পদ্ধতির ভিন্নতা। খাসিয়া পান দেশের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানীও হয়। এ সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ সবাই পান চাষের সাথে সম্পৃক্ত। এই পান জিআই স্বীকৃতি অর্জনের মাধ্যমে খাসিয়াদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

সিলেটের কমলা
সিলেটের কমলা। ছবি: সিলেট টুডে

সিলেটের কমলা

আরেকটি বিখ্যাত ফলের নাম কমলা। এই কমলা সিলেটের পাশাপাশি যায় বিদেশেও। পুরাতন বই পত্রে পাওয়া যায় কমলার নাম। খাসিয়াপুঞ্জিতে উৎপাদিত কমলার সুখ্যাতি রয়েছে। সিলেটে দেড়’শ এর বেশি বাগানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় কমলা। খাসিয়াপুঞ্জি ছাড়াও বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জাফলং, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে অধিক পরিমাণে কমলা চাষ হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক একটি কমলা গাছে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কমলা পাওয়া যায় বছরে। কমলার স্বাস্থ্য উপকারিতার কথা আমরা সবাই জানি। সিলেটের কমলার স্বাদ ভিন্ন। তাই এই কমলার চাহিদা, সুনাম, ও পরিচিতি বাড়াতে জিআই স্বীকৃতির চেষ্টা করা দরকার।

এগুলো ছাড়াও সিলেটে অসংখ্য পণ্য রয়েছৈ জিআই স্বীকৃতি অর্জনের মতো। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সিলেটে বাড়তে পারে জিআই পণ্যের সংখ্যা।

Leave a Reply

Scroll to Top